নাটোরে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণায় দ্বিধা বিভক্ত ভোটের রাজনীতি, আতঙ্কে জনগণ

নিজস্ব প্রতিবেদক, নাটোর: পুরো জেলা বিএনপির রাজনীতি বর্তমানে গভীর অভ্যন্তরীণ সংকটে নিমজ্জিত। দলের দীর্ঘদিনের ত্যাগী ও মাঠের নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি, প্রভাব বিস্তার এবং এক নেতা কেন্দ্রীক ক্ষমতার রাজনৈতিক চাপে আজ অসহায় হয়ে পড়েছেন। বিএনপির মনোনয়ন ও সাংগঠনিক অবস্থান ঘিরে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃত্বের মধ্যে গভীর মতবিরোধ ও বিভাজন দেখা দিয়েছে। দলের ত্যাগী ও মাঠের নেতাকর্মীরা বলছেন, জেলা বিএনপি এখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রভাব, অপরাধ কর্মকাণ্ড ও চাঁদাবাজ রাজনীতির কবলে পড়েছে। মনোনয়ন ও সাংগঠনিক অবস্থান ঘিরে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃত্বের মধ্যে তৈরি হয়েছে তীব্র মতবিরোধ। মুখে কেউ প্রকাশ্যে কিছু না বললেও, ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দিন দিন বাড়ছে। তৃণমূল নেতাকর্মী ও ভোটারদের আশঙ্কা, এই বিভাজন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। যে প্রভাবে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী হওয়া দুস্কর হয়ে পড়বে।

নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া): এই আসনে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে সাবেক প্রতিমন্ত্রী ফজলুর রহমান পটলের কন্যা, দলের মিডিয়া সেলের সদস্য ও জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুলকে। পুতুল দলের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির বিশেষ সহকারী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। স্থানীয় রাজনীতিতে তিনি ব্যতিক্রমধর্মী ও আদর্শিক রাজনীতির প্রতীক হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।
তবে মনোনয়নকে ঘিরে দ্বন্দ্বও কম নয়। তার বড় ভাই ডা. ইয়াসির আরশাদ রাজনও একই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তিনি সাবেক উপমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। জানা গেছে, দুলু নিজ বলয় শক্ত করতে রাজনকে সমর্থন দিয়ে পুতুলের বিরোধিতা করাচ্ছেন।

জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, রুহুল কুদ্দুস দুলু দীর্ঘদিন ধরে দলীয় রাজনীতিকে ব্যক্তি কেন্দ্রিকভাবে পরিচালনা করছেন। এর ফলে ত্যাগী ও মাঠের নেতারা বঞ্চিত হচ্ছেন। তৃণমূল পর্যায়ের অভিযোগ, রুহুল কুদ্দুস দুলুর অনুসারীদের চাঁদাবাজি ও দখলবাজির কারণে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। তবে ঐতিহাসিকভাবে এই আসনে বিএনপির শক্ত অবস্থান রয়েছে। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত টানা চারবার নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির সাবেক প্রতিমন্ত্রী ফজলুর রহমান পটল। স্থানীয়রা বলছেন, বর্তমানে সাহসী নেত্রী ফারজানা শারমিন পুতুলই মাঠে বিএনপির সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ।

নাটোর-২ (নাটোর সদর–নলডাঙ্গা): এই আসনে বিএনপির প্রার্থী সাবেক অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। তিনি তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক উপমন্ত্রী। তবে দুলুর নেতৃত্ব নিয়ে দলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। স্থানীয় নেতারা অভিযোগ করেন, রুহুল কুদ্দুস দুলুর অনুসারীদের দাপট ও বলয় ভিত্তিক রাজনীতির কারণে দল বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং সাধারণ জনগণের মাঝে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বাড়ছে। দলীয় সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট- পরিবর্তনের পর ঠিকাদারি, বাস মালিক, দলিল লেখক ও চামড়া ব্যবসাসহ বিভিন্ন খাত রুহুল কুদ্দুস দুলুর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। জেলা বিএনপির তিনজন শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় সাবেক উপমন্ত্রী দুলুর প্রত্যক্ষ নির্দেশে। রুহুল কুদ্দুস দুলুর সহচর ও ঘনিষ্ঠ জন হিসেবে পরিচিত ফরহাদ আলী ওরফে দেওয়ান শাহীনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অসংখ্য অভিযোগ নাটোরের মানুষের মুখে মুখে। স্থানীয়রা তাকে “নাটোরের গডফাদার” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

তবে রুহুল কুদ্দুস দুলু এসব অভিযোগ অস্বীকার করে একাধিক সভায় বলেছেন, বিএনপির নামে কেউ অন্যায়, অত্যাচার বা সন্ত্রাসে জড়ালে তার দাঁত ও হাত ভেঙে দেওয়া হবে। এই আসনে তরুণ নেতৃত্বের মধ্যে জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য ও আমরা বিএনপি পরিবারের উপদেষ্টা আবুল কাশেম ও জেলা সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান আসাদকে ভোটাররা গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় বিকল্প প্রার্থী হিসেবে দেখছেন।

নাটোর-৩ (সিংড়া): এই আসনে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা হয়নি। জেলা বিএনপির সদস্য অধ্যক্ষ আনোয়ারুল ইসলাম আনু দাবি করেছেন, তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছ থেকে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পাননি। তবে দলের অভ্যন্তরে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, কারণ আনু সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সহধর্মিণী কনিকা’র আপন চাচা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রফেসর কাজী গোলাম মোর্শেদ, সাবেক সংসদ সদস্য ও ত্যাগী নেতা, এখানকার মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি বলেন, আমি দীর্ঘদিন সিংড়ায় দলের জন্য কাজ করেছি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আমাকে সুযোগ দিলে দলীয় ঐতিহ্য রক্ষায় জনগণের সমর্থনে শক্তভাবে মাঠে নামব।

ইতিহাসে দেখা যায়, এই আসনে ১৯৯১ ও ২০০১ সালে প্রফেসর কাজী গোলাম মোর্শেদ বিজয়ী হয়েছিলেন। সিংড়া উপজেলার চলনবিল অধ্যুষিত এলাকায় তার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড আজও প্রশংসিত।

নাটোর-৪ (গুরুদাসপুর–বড়াইগ্রাম): এই আসনে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাহমুদ আব্দুল আজিজকে। কিন্তু মনোনয়ন ঘোষণার আগে থেকেই এলাকায় তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে। তৃণমূল নেতারা বলছেন, আজিজের আশপাশে এখন এমন একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে যারা দলের বদলে ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজ করছে। জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান আসাদ প্রকাশ্যে বলেছেন, এই মনোনয়ন দলের ভাবমূর্তির সঙ্গে কোন ভাবেই যায় না।
এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন ব্যারিস্টার আবু হেনা মোস্তফা কামাল রঞ্জু ও জন গোমেজ। যারা তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক আলোচিত এবং জনপ্রিয়তার নিরিখে অনেক দূর এগিয়ে। এই আসনের একাধিক নবীন-প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, মাহমুদ আব্দুল আজিজ রুহুল কুদ্দুস দুলুর একজন ঘনিষ্ঠ অনুসারী এবং ৫ আগস্টের পর গুরুদাসপুর- বড়াইগ্রামে তার নেতৃত্বে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। তার সরাসরি ইন্ধনে লুট হয়েছে পুকুরের মাছ ও ওয়ালটন প্লাজা।

বরাইগ্রামের আইনজীবী ও জেলা বিএনপির নির্বাহী সদস্য মো. শরীফুল ইসলাম মুক্তা বলেন, নাটোরে বিএনপির মধ্যে এখন ভয় ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। কেউ সত্য বললে তার নিরাপত্তা থাকছে না। তবে জনগণ ভোটের বাক্সেই এবার জবাব দেবে।

নাটোর বিএনপির রাজনীতি বর্তমানে গোষ্ঠী, প্রভাব ও ত্যাগীদের উপেক্ষার এক জটিল সমীকরণে এসে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের মতে, বিএনপি যদি প্রভাবশালী বলয়ের কবল থেকে বেরিয়ে আদর্শিক ও ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়, তবে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দলের জন্য নাটোর হবে একটি কঠিন পরীক্ষা ক্ষেত্র। যেখানে চরম কষ্টকর হবে আসনগুলোতে প্রার্থীদের বিজয়ী হওয়া।